পেন্সিলে লিখা বাবার ডায়েরি (ধারাবাহিক উপন্যাসঃ পর্ব- ৪)
লিখেছেন লিখেছেন মামুন ১৯ নভেম্বর, ২০১৪, ০৬:৩৫:২৮ সন্ধ্যা
আমার বাবু!
এর আগের লিখাগুলোতে তুমি জেনেছ আমার ছেলেবেলার কথা... আমাদের একান্নবর্তী পরিবারের হাসি-আনন্দের কথা। এই অধ্যায়েও গ্রামেই রয়েছি।
গ্রামের সবুজ ক্ষেতগুলি তখন ধীরে ধীরে সোনালী হয়ে আসছিলো। যাদের চাষবাস ছিলো তাদের ঘরে ঘরে ফসল তোলার আয়োজন হচ্ছে। বাতাসের ঘ্রাণ বদলে যেত এই সময়টাতে। গোসল করে ভিজা গামছাটা মাথা থেকে খোলার সময় আম্মার পাশে দাঁড়ালে যেমন লাগতো, এই সময়টাতে গ্রামটাকে আমার তেমনই লাগতো।
ঘরে নতুন বাঁশের ডোল। গোলা মেরামত করে পরিষ্কার করে রাখা। চারপাশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। লেপাপোছা উঠান। গরুগুলি বাড়তি যত্নে তরতাজা। ঝাড়ু দেয়া রাস্তা। রাস্তার দুই পাশে ক্ষেতগুলিতে কোথাও কোথাও কাটা ধান। আঁটি বাঁধার জন্য গোছানো। সবার মন খুশি খুশি। যার ঘরে ধান উঠবে সে তো খুশিই। তার পাশের জন ও খুশি। কারণ সে ও কোন ভাবে পাবে। পিঠা পায়েসতো পাবেই। পথে পড়ে থাকা ধান কুড়িয়ে ও কারো কারো দুই এক বেলা হয়ে যাবে। নতুন ধানের, নতুন চালের ভাতের ঘ্রাণ কি সুন্দর!
এই রকম নিকট সুসময়ের ঘ্রাণমাখা এক বিকালে স্কুল থেকে আসার পথে দেখলাম চেয়ারম্যান সাহেব লোকজন নিয়ে কোথাও যাচ্ছেন। বেশ উত্তেজিত মনে হলো। আমি তার আগেই জমির আলপথে নেমে গেছি। উঁচু রাস্তা থেকে ভেসে আসা দুই একটা কথা যা শুনলাম, তা দিয়ে কিছুই ভালোভাবে বুঝলাম না। ওরা যখন বাঁক ফিরে চোখের আড়ালে চলে যাচ্ছে আমার মনে হলো ওরা বোধ হয় আব্বার কথা বলছে। বইখাতা রেখে তাড়াহুড়া করে কিছু খেয়ে খেলতে চলে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ চেয়ারম্যান দাদার কথা মনে হলো। ফিরে গিয়ে আম্মাকে খুঁজলাম। রান্নাঘরের পিছনে লাকড়ি গুছাচ্ছিলেন আম্মা। আমার কথা শুনে উনার মুখটা কেমন মলিন আর শুকনা হয়ে গেল। আবার যখন ছুটে বের হচ্ছি আমাকে ডেকে বললেন, " মতির দোকানে তোর আব্বাকে দেখলে বলিস আজকে যেন বাজারে না যায়। আলো থাকতে বাসায় আসে " ।
রাত্রে খাওয়া শেষে দুই ভাই শুয়েছি। আমার একটু একটু ঘুম এসেছে। খাট ক্যাঁচক্যাঁচ করে উঠে আমার ঘুমটা ভেংগে দিল। বাবলু ঘুম। আম্মা খাটে উঠে বসেছেন। আব্বা পড়ার টেবিলের একমাত্র চেয়ারটাতে বসা। আমি চোখ বন্ধ করে দুজনের কথা শুনতে লাগলাম। সেই রাতে আমার চোখে গ্রামের নতুন একটা ছবি ধরা পড়লো। অবারিত নীল আকাশ আর দিগন্ত ছোঁয়া সবুজ মাঠ, খালের স্রোত আর স্কুলের উদ্দাম উচ্ছ্বাস কোলাহলকে পিছনে রেখে সামনে এসে দাঁড়ালো মানুষ। নোংরা, হিংস্র রাজনীতির সাথে পরিচয় হলো। জোতদার ভুমিপতিদের শক্তি আর সেই শক্তি দিয়ে দুর্বল সামর্থ্যের মানুষকে শিকারের নিয়ম জানলাম। আব্বা আম্মার অচেনা এক রূপ দেখলাম। জানলাম - আমরা গরীব! শক্তিহীন! শক্তিমানের নির্যাতনের শিকার হবার জন্য উপযুক্ত! জীবনে প্রথম নিজেকে ঘৃণা করলাম! ঘৃণায় কী শক্তি তা না জেনেই দুই হাত মুঠো করে শপথ করলাম - বড় হবো! হতে হবে! কত আলগোছে সমাজের নির্যাতিত অংশ ছেড়ে প্রতিবাদী অংশে উঠে গিয়েছি আমরা সেদিন - তা জেনেছি আরো অনেক পরে।
এলাকার একটা বংশ বরাবর চেয়ারম্যান হয়ে আসছিল। এটা চেয়ারম্যানবাড়ি নামে পরিচিত ছিল। এই বাড়ির ছেলেপুলে এবং বয়ষ্করা তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি এবং অর্থবিত্তের জোরে এলাকার অন্যদের উপর রাজত্ব করে আসছিল। এরা প্রতিবারই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তির দ্বারা নিজেদের লোকাল অবস্থানকে সুসংহত করে আসছিল। এক ভাই আওয়ামী লীগ করলে, বাকীরা হয় বি এন পি, নয় জামায়াতে ইসলামী বা জাতীয় পার্টির সমর্থন করতো। এরা প্রতিবারই এভাবে ক্ষমতাসীনদের সাথেই থাকতো। শুরু থেকেই পৃথিবীর প্রত্যেক বসতিতে বোধ হয় এমন দুই একটা পরিবার বা গোষ্ঠী ছিল, আছে, থাকবে।
আব্বা তখন এলাকার হাইস্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক। চেয়ারম্যান বাড়ির যে কোনো ছাত্রের সাথে কিছু একটা নিয়ে দ্বন্দ্ব হয়েছিল। এরপর স্কুলের মাঠে টিফিন টাইমে সবার সামনে আব্বাকে চেয়ারম্যান অপমান করলো। হুমকি দিলো। আমি লোকটাকে দেখছিলাম। এতটা নির্লজ্জ! এতটা দাম্ভিক! ক্ষমতার দাপট! আব্বা তার মুরুব্বিজনের মুখের উপর কোন জবাব দিলেন না। চোখে চোখে তাকালেন না পর্যন্ত। কিন্তু তবু আমার মনে হচ্ছিল বাবা রাগে একটা ভয়ংকর বাঘ হয়ে যাচ্ছে! নিজেকে মনে হচ্ছিল বাচ্চা বাঘ!
এই ঘটনারই ছাপ বোধ হয় এতটা পড়েছিল আমার মনে, স্বভাবে, চিন্তায় কাজে - পরবর্তীতে একটা চরমপন্থীদলে যোগ দিয়ে শ্রেণী শত্রু খতমের নামে ভ্রান্ত মতবাদে দীক্ষা নিয়েছিলাম। অবশ্য, ফিরেও আসতে পেরেছিলাম।
সারা পৃথিবীতে কম্যুনিষ্ট আন্দোলনের যে ধাক্কা লেগেছিল যুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশের প্রথম দিনগুলিতে তার কম্পন বেশ ভালোই উঠেছিল। শুরুতে টগবগে আবেগ আর দিন বদলের তীব্র আকাংখায় যারা মন প্রাণ সমর্পণ করেছিল তাদের সাথে প্রাণের টানে - বিশ্বাসের আকর্ষণে যোগ দিয়েছিলাম। অনেক ভালো ভালো চিন্তা ছিল। কঠিন আদর্শ ছিল। মনে মনে প্রত্যেকেই এক একজন চে'গুয়েভারা। পৃথিবীর কোথায় কোন কোণায় সমাজতন্ত্র আন্দোলনে নেমে 'রে রে ' রবে পুজিবাদকে তাড়া করেছে - প্রতিদিনের জয় পরাজয়ের খবর স্নায়ুকে টানটান করে রাখতো। যে কোন রকম ভাংচুর, যে কোন লোকসানের বিনিময়ে হোক যৌথখামার হতেই হবে! জীবনের কী দাম যদি দুনিয়াকে বদলাতে না পারি? অনাচার অবিচার বন্ধ করার জন্য যা দরকার - যেভাবে দরকার করতেই হবে! ধনী - দরিদ্রের বিভক্ত পৃথিবীকে এক পৃথিবী করার জন্য, অন্তত একটা সুখী, দু:খ -দারিদ্র্য-অশান্তিমুক্ত দেশের জন্য, যুগ যুগান্ত ধরে চলে আসা 'দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার ' শেষ করার জন্য একটা দুটো জীবন বলি দিলে কী আসে যায়। একটা দুটো পরিবারের সাময়িক কষ্ট তো নগন্যই। এই উৎসর্গের মহিমা অপার।
দলেতো ঢুকলাম। এক এক করে খুলতে লাগলো এক এক অচেনা জগতের প্রবেশ দুয়ার। এক সময় আবিষ্কার করলাম - দলে টিকে থাকার জন্য, দলকে টিকিয়ে রাখার জন্য কখন অজান্তেই দুর্বলের দল ছেড়ে সবলের দলে যোগ দিয়েছি! শৈশবের চোখে নিজেকে দেখে বংশ পরম্পরায় চেয়ারম্যান পরিবারের চেয়ারম্যানদের সাথে নিজের খুব বেশি তফাত পেলাম না। বাঘের বদলে শিয়াল হয়ে বাঘ চরাতে শুরু করেছি! স্রেফ একটি চাঁদাবাজ এবং গলা কাটার রাজনৈতিক দলের সদস্যে পরিণত হয়েছি!
এ অনেক পরের কথা। আগের কথায় ফিরি।
যা বলছিলাম, চেয়ারম্যানের দ্বারা অপমানিত হবার পরে আব্বার অপর দুই ভাই আব্বাকে অনেক বকাঝকা করেন। একদিকে চেয়ারম্যান বাড়ির যুবক ছেলেদের অত্যাচার, উপুর্যুপরি চেয়্যারম্যানের দম্ভ ভরা উক্তির অপমান এবং নিজের দুই ছেলেদের অনাগত ভবিষ্যৎ জীবনে স্বস্তি আর নিরাপত্তার অনিশ্চয়তা - তার ওপর চাচাদের দুর্ব্যবহার। এই প্রথম এরা তিন ভাই নিজেরকে ঐক্যবদ্ধ করতে ব্যর্থ হন।
এই প্রথম অপর পক্ষের ক্ষমতার দাপটে এবং নিজেদের আরাম ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে ভয়ে এরা ভাইয়ের পক্ষ নিতে ভয় পান। তোমার দাদু অভিমানে তার দুই ছেলেকে নিয়ে আজন্ম সম্পর্কের গ্রাম ছেড়ে শহরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। তখন জিয়ার আমল।
মিথিলা বাবু!
তোমার দাদা ভাই খুবই চাপা স্বভাবের ছিলেন।
চেয়ারম্যানের সাথে সেই গন্ডগোলের পর বড় দুই ভাই উল্টো ওদের পক্ষ নেয়ার ক্ষোভ- দুঃখ আব্বা কোন দিন ভুলতে পারেননি। মনের কষ্টে শেকড় উপড়ে একজন মানুষ ইটপাথরের প্রানহীন এক শহরে আসতে বাধ্য হন। সম্পূর্ণ নতুন এক জীবন শুরু করেন।
চিরকালই রাজনীতির শিকার হয়ে সাধারন মানুষেরা জোতদার ভুমিপতিদের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়। তাদের সাথে বিবাদে যাওয়া জলে থেকে কুমিরের সাথে লড়াইয়ের মতই। তাতে জিততে হলে সেই জলের বাইরে এসে আরো বড় কুমির হয়ে ফিরতে হয়।
(ক্রমশঃ)
বিষয়: সাহিত্য
১০১৫ বার পঠিত, ১৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
লেখা ভালো হৈছে আজকে আর অনুভূতি রেখে গেলাম না নিজের কাছেই রেখে দিলাম।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
আপনার দোয়ায় আমীন।
শুভসকাল।
আপনি যেটুকু অনুভূতি রেখে গেলেন, অনেক ভালো লাগলো। এই বিষয়টি (সমাজের শ্রেনি বৈষম্য) আমি নিজেও অনেক কম বুঝি, তারপরও লিখায় চলে এসেছে।
অনেক শুভকামনা রইলো।
আপনাকে ধন্যবাদ।
হ্যা, ডায়েরিটা একটা রহস্য হয়েই থেকে যাবে।
শুভসকাল।
সোনালী ধান কাটার মৌসুম সমাগত! বাড়ী থেকে এমন সংবাদই পেলাম!আপনার লেখা টেনে নিল সেই সব ফেলে আসা দিন গুলোর পানে!
বরাবরের মতই নান্দনিক সাবলীল উপস্হাপনা মুগ্ধ করল! অনেক ধন্যবাদ ও জাযাকাল্লাহু খাইরান জানালাম!!
আপনাকেও অনেক অনেক ধন্যবাদ ও শুভকামনা।
ইদানিং অফিসে কাজের চাপ বেশী। বছর শেষের দিকে, সামনে বাৎসরিক অডিট। আর নিজের ডান হা্তটাও শীত আসার সাথে সাথে কেমন বিবশ লাগছে। টাইপ করতে কষ্ট হয়। সব কিছু মিলিয়ে কেমন যেন স্লো হয়ে গেছি।
তবে ইনশা আল্লাহ খুব দ্রুত কাটিয়ে উঠব।
মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
আপনার কি ফেসবুক একাউন্ট রয়েছে?
মন্তব্য করতে লগইন করুন